সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, জ্যৈষ্ঠ মাসে পাকা ও মিষ্টি ফলের মৌ মৌ গন্ধে মাতোয়ারা বাংলার দিক প্রান্তর। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, তরমুজ, বাঙ্গিসহ মৌসুমি ফলের সুভাষিত ঘ্রাণ আমাদের রসনাকে আরো বাড়িয়ে দিয়ে যায়। এছাড়াও মৌসুমি ফলের প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে তৈরি আচার, চাটনি, জ্যাম, জেলি জ্যৈষ্ঠের গরমে ভিন্ন স্বাদের ব্যঞ্জনা নিয়ে হাজির হয়। আর এই মধুমাসে প্রিয় পাঠক, চলুন একপলকে জেনে নেই জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষি কথা।
বোরো ধান
- আপনার জমির ধান শতকরা ৮০ ভাগ পেকে গেলে জমির ধান সংগ্রহ করে কেটে মাড়াই, ঝাড়াই করে ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে এবং শুকনো বীজ ছায়ায় ঠান্ডা করে প্লাস্টিকের ড্রাম, বিস্কুটের টিন, মাটির কলসি এসবে সঠিকভাবে সংরক্ষন করতে হবে।
আউশ ধান
* এখনো আউশের বীজ বোনা না হয়ে থাকলে এখনই বীজ বপন করতে হবে।
* চারার বয়স ১২ থেকে ১৫ দিন হলে ইউরিয়া সারের প্রথম কিস্তি হিসেবে হেক্টরপ্রতি ৪৫ কেজি ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। এর ১৫ দিন পর একই মাত্রায় দ্বিতীয় কিস্তি উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
* ইউরিয়া সারের কার্যকারিতা বাড়াতে জমিতে সার প্রয়োগের সময় ছিপছিপে পানি রাখাসহ জমি আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।
আমন ধান
- নিচু এলাকায় বোরো ধান কাটার ৭-১০ দিন আগে বোনা আমনের বীজ ছিটিয়ে দিলে বা বোরো ধান কাটার সাথে সাথে আমন ধানের চারা রোপণ করলে বন্যা বা বর্ষার পানি আসার আগেই চারা সতেজ হয়ে ওঠে এবং পানি বাড়ার সাথে সাথে সমান তালে বাড়ে।
- চারা রোপণের ১০-১৫ দিন পর সামান্য পরিমান ইউরিয়া ছিটিয়ে দিলে চারা তাড়াতাড়ি বাড়ে এবং ফলন ভাল হয়।
- এ মাসের মধ্যেই রোপা আমনের জন্য বীজতলা তৈরি করতে হবে।
- রোদ পরে এমন উচু জমি নির্বাচন করে চাষ, মই, পানি দিয়ে ভালভাবে থকথকে কাঁদাময় করে নিতে হবে।
- জমি উর্বর হলে সাধারণত কোন রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয় না, তবে অনুর্বর হলে প্রতি বর্গমিটার বীজতলার জন্য ২ কেজি জৈবসার মাটির সাথে মিশিয়ে দিলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
- প্রতি বর্গমিটার জমির জন্য ৮০গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।
- বীজ বোনার আগে অংকুরিত করে নিলে তাড়াতাড়ি চারা গজায়, এতে পাখি বা অন্য কারনে ক্ষতি কম হয়।
- বীজ বোনার আগে বীজতলায় একস্তর ছাই ছিটিয়ে দিলে চারা তোলার সময় উপকার পাওয়া যায়।
- ভাল চারা পাওয়ার জন্য বীজতলায় নিয়মিত সেচ দেয়া, অতিরিক্ত পানি নিকাশের ব্যবস্থা করা, আগাছা দমন, সবুজ পাতা ফড়িং ও থ্রিপস এর আক্রমণ প্রতিহত করাসহ অন্যান্য কাজগুলো সতর্কতার সাথে করতে হবে।
- চারা হলুদ হলে প্রতি বর্গমিটারে ৭ গ্রাম করে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করলে ভাল ফল পাওয়া যায়। এরপরও যদি চারা হলুদ থাকে তবে প্রতি বর্গমিটারে ১০ গ্রাম করে জিপসাম সার প্রয়োগ করতে হবে।
- জ্যৈষ্ঠ মাসে আউস ও বোনা আমনের জমিতে পামরী পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। পামরী পোকা ও এর কীড়া পাতার সবুজ অংশ খেয়ে গাছের অনেক ক্ষতি করে। আক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে হাতজাল, গামছা, লুঙ্গি, মশারি দিয়ে পামরী পোকা ধরে মেরে ফেলে আক্রমণ কমানো যায়। তাছাড়া আক্রান্ত গাছের গোড়া থেকে ৫ সেন্টিমিটার (২ ইঞ্চি) রেখে বাকি অংশ কেটে কীড়া ও পোকা ধ্বংস করা যায়। আক্রমণ যদি বেশি হয় অর্থাৎ প্রতি গাছে ৪টি বয়স্ক পামরী পোকা বা প্রতি পাতায় ১৫টি কীড়া দেখা দিলে অথবা জমির শতকরা ৩৫টি পাতা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হলে অনুমোদিত কীটনাশক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
পাট
* পাটের জমিতে আগাছা পরিষ্কার, ঘন ও দুর্বল চারা তুলে পাতলা করা, সেচ এসব কাজগুলো যথাযথভাবে করতে হবে।
* ফাল্গুনি তোষা জাতের জন্য হেক্টরপ্রতি ১০০ কেজি ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
* মাটিতে রস না থাকলে বা দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হলে হালকা সেচ দিতে হবে এবং বৃষ্টির করনে পানি জমে থাকলে তা নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
* পাটের শাক যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টিকর। তাই নিড়ারিন সময় তোলা অতিরিক্ত পাটের চারা ফেলে না দিয়ে শাক হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
* এ মাসে পাটের বিছাপোকা এবং ঘোড়া পোকা জমিতে আক্রমণ করে থাকে। বিছা পোকা দলবদ্ধভাবে পাতা ও ডগা খায়, ঘোড়া পোকা গাছের কচি পাতা ও ডগা খেয়ে পাটের অনেক ক্ষতি করে থাকে। বিছা পোকা ও ঘোড়া পোকার আক্রমন রোধ করতে পোকার ডিমের গাদা, পাতার নিচ থেকে পোকা সংগ্রহ করে মেরে বা পুরিয়ে ফেলতে হবে। জমিতে ডালপালা পুতে দিলে পোকা খাদক পাখি যেমন শালিক, ফিঙ্গে এসব পোকা খেয়ে আমাদের দারুন উপকার করে। আক্রমণ বেশি হলে অনুমোদিত কীটনাশক সঠিকভাবে, সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
শাক-সবজি
- মাঠে বা বসত বাড়ির আঙ্গিনায় গ্রীষ্মকালীন শাকসবজির পরিচর্যা সতর্কতার সাথ করতে হবে। এ সময় সারের উপরি প্রয়োগ, আগাছা পরিষ্কার, গোড়ায় বা কেলিতে মাটি তুলে দেয়া, লতা জাতীয় সবজির জন্য বাউনি বা মাচার ব্যবস্থা করা খুব জরুরি।
- লতানো সবজির দৈহিক বৃদ্ধি যত বেশি হবে তার ফুল ফল ধারণ ক্ষমতা তত কমে যায়। সেজন্য বেশি বৃদ্ধি সমৃদ্ধ লতার/গাছের ১৫-২০ শতাংশের পাতা লতা কেটে দিলে তাড়াতাড়ি ফুল ও ফল ধরবে।
- কুমড়া জাতীয় সব সবজিতে হাত পরাগায়ন বা কৃত্রিম পরাগায়ন অধিক ফলনে দারুণভাবে সহায়তা করবে। গাছে ফুল ধরা শুরু হলে প্রতিদিন ভোরবেলা হাতপরাগায়ন নিশ্চিত করলে ফলন অনেক বেড়ে যাবে।
- এ মাসে কুমড়া জাতীয় ফসলে মাছি পোকা দারুন ভাবে ক্ষতি করে থাকে। এক্ষেত্রে জমিতে খুঁটি বসিয়ে খুঁটির মাথায় বিষটোপ ফাঁদ দিলে বেশ উপকার হয়। এছাড়া সেক্স ফেরোমন ব্যবহার করেও এ পোকার আক্রমণ রোধ করা যায়।
- সবজিতে ফল ছিদ্রকারী পোকা, জাব পোকা, বিভিন্ন বিটল পোকা সবুজ পাতা খেয়ে ফেলতে পারে। হাত বাছাই, পোকা ধরার ফাঁদ, ছাই ব্যবহার করে এসব পোকা দমন করা যায়। তাছাড়া আক্রান্ত অংশ কেটে ফেলে এবং সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসেবে বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে।
- মাটির জো অবস্থা বুঝে প্রয়োজনে হালকা সেচ দিতে হবে। সে সাথে পানি নিকাশের ব্যবস্থা সতর্কতার সাথে অনুসরণ করতে হবে।
বিবিধ
* বাড়ির কাছাকাছি উঁচু এমনকি আধা ছায়াযুক্ত জায়গায় আদা হলুদের চাষ করতে পারেন।
* মাঠের মিষ্টি আলু, চিনাবাদাম বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই তুলে ফেলতে হবে।
* গ্রীষ্মকালীন মুগডালের চাষও এ মাসে করতে পারেন।
* পতিত বা আধা ছায় যুক্ত স্থানে সুযোগ থাকলে অনায়াসে লতিরাজ বা পানি কচু বা অন্যান্য উপযোগী কচুর চাষ করতে পারেন।
* যারা সবুজ সার করার জন্য ধইঞ্চা বা অন্য গাছ লাগিয়ে ছিলেন, তাদের চারার বয়স ৩৫-৪৫ দিন হলে চাষ ও মই দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। সবুজ সার মাটিতে মেশানোর ৭/১০ দিন পরই ধান বা অন্যান্য চারা রোপণ করতে পারবেন।
গাছপালা
- আগামী মাসে চারা লাগানোর জন্য জায়গা নির্বাচন, গর্ত তৈরি ও গর্ত প্রস্তুতি, সারের প্রাথমিক প্রয়োগ, চারা নির্বাচন এ কাজগুলো এমাসেই শেষ করে ফেলতে হবে।
- উপযুক্ত মাতৃগাছ থেকে ভালবীজ সংগ্রহ করে নারকেল, সুপারির বীজ বীজতলায় এখন লাগাতে পারেন।
প্রাণিসম্পদ
* এ সময়ে প্রাণিচিকৎসকের সাথে পরামর্শ করে হাঁস মুরগির ভ্যাকসিন দিতে হবে।
* বাজারে রাণীক্ষেতের জন্য নবিলিস এনডি ল্যাসুটা, এনডিএলএস, সিভেক নিউ এল, আইজোভ্যাক এনডি কিল্ড, নিউক্যাভাক, ইমোপস্টে, নিউক্যাসেল ল্যাসুটা এসব। এছাড়া গামবোরো রোগে নবিলিস ২২৮, সিভেক গামবো এল, আইজোভ্যাক গামবো-২এসব। আর বসন্ত রোগে সিভেক এফপিএল, নবিলিস, ওভোড্রিপথেরিন এসব পাওয়া যায়।
* এছাড়া হাঁস মুরগির কৃমির জন্য ওষুধ খাওয়ানো, ককসিডিয়া রোগ হলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহাণ এবং জরুরিভাবে অন্যান্য প্রতিষেধক টিকা দিয়ে দিতে হবে।
* মুরগি ও হাঁসের বাচ্চা ফোটানোর কাজটি ভরা বর্ষার আগেই সেরে ফেলতে হবে।
* বর্ষা আসার আগেই গবাদি পশুর আবাসস্থল পরিপাটি করে পুনঃসংস্কার, আশপাশ পরিষ্কার করা, জমে থাকা পানির দ্রুত নিকাশের ব্যবস্থা, বর্ষার নিয়মিত এবং পরিমিত গো-খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করাসহ অন্যান্য কাজগুলো সঠিকভাবে করতে হবে।
* গবাদি পশুর গলাফোল, ডায়রিয়া, ক্ষুরারোগ, নিউমোনিয়াসহ অন্যান্য রোগের ব্যাপারে টিকা দেয়াসহ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিতে হবে।
মৎস্যসম্পদ
- মাছ প্রজননে আগ্রহী চাষীভাইদের স্ত্রী-পুরুষ মাছ (ব্রুড ফিশ), পিটুইটারি গ্রন্থি, হাপা এবং ইনজেকশনের সরঞ্জামাদি প্রস্তুত রাখতে হবে।
- আঁতুড় পুকুর বন্যায় ডুবে যাবার আশঙ্কা থাকলে পাড় উঁচু করে বেঁধে দিতে হবে। আঁতুড় পুকুরে পোনার আকার ১ ইঞ্চি হলে সাবধানে ধরে চারা পুকুরে ছাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
- নিয়মিত তদারকী, রাক্ষুসে মাছ তোলা, আগাছা বা জংলা পরিষ্কার, খাবার দেয়া, সার দেয়া, সম্পূরক খাবার দেয়া, জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা এসব প্রাসঙ্গিক কাজগুলো নিয়মিত করতে হবে।
- এছাড়া যে কোন সমস্যায় উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, আপনাদের কল্যাণে ও সফলতার জন্য আমরা এক মাস আগেই আগামী মাসের কৃষির করণীয় দিকগুলো স্মরণ করিয়ে দেই। আমাদের বিশ্বাস সুষ্ঠভাবে কার্যক্রম বাস্তবায়নে আপনাদের প্রাথমিক প্রস্তুতি নিতে এগুলো বিশেষভাবে সহায়তা করে থাকে। এরপরও যদি আরও নতুন কোন তথ্য প্রযুক্তি বা কৌশল জানার থাকে তাহলে স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, কৃষি-মৎস্য-প্রাণি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করে ব্যবস্থা নিলে আরো বেশি লাভবান হবেন।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মনঞ্জুর হোসেন, তথ্য অফিসার (কৃষি)
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন, তথ্য অফিসার (কৃষি)
কৃষি তথ্য সার্ভিস